প্রশ্নঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যা কাঠামোর বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর।
অথবা, জনসংখ্যার বিন্যাসে প্রভাব বিস্তারকারী নিয়ামক সমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা: পৃথিবীতে জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হচ্ছে অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র। এ দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার খুবই বেশি। আর এর পিছনে মূল কারণ হলো উচ্চ জন্মহার। তাছাড়া জনস্বাস্থ্যে সার্বিক উন্নয়নের ফলে মৃত্যুর হার যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমান মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫.০ জন কিন্তু জন্মহার প্রতি হাজারে ১৮.০৩ জন । অর্থাৎ প্রতি বছর জনসংখ্যা শতকরা ১.৩৭ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১. জনসংখ্যার আয়তন বৃদ্ধির হার: বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এদেশের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে কিংবা স্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পেলেও ১৯৫০ সালের পর থেকে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৯২ লক্ষ। বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৯৮ লক্ষ ।
২. জনসংখ্যার ঘনত্ব: বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। কৃষিকাজের উপযোগী বিস্তৃত ও উর্বর সমভূমি এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এ ভূখণ্ডে জনবসতির জন্য সহায়ক। এ কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এবং প্রতিবেশী অন্যান্য দেশ অপেক্ষা এ দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। ২০১১ সালের আদমশুমারির প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৬৪ জন লোক বাস করে। ২০০১ সালে যা ছিল প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮৩৪ জন। তবে বিভাগ এবং জেলাভেদে জনসংখ্যার ঘনত্বের তারতম্য দেখা যায়।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি মূল্যায়ন কর।
৩. মহিলা-পুরুষ অনুপাত: মহিলা-পুরুষ অনুপাত প্রতি ১০০ জন মহিলার বিপরীতে কতজন পুরুষ আছে তা নির্ণয় করা হয়। মহিলা-পুরুষ অনুপাত ১০০-এর বেশি হলে পুরুষের সংখ্যা বেশি হয় আর ১০০-এর কম হলে মহিলার সংখ্যা বেশি হয়। মহিলা-পুরুষ অনুপাত সাধারণত ১০০-এর আশেপাশে হয়। ২০১১ সালের আদমশুমারির প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ৭,১২,৫৫,০০০ জন পুরুষ এবং ৭,১০,৬৪,০০০ জন মহিলা আছে ।
৪. জনসংখ্যার বয়স কাঠামো: বয়স কাঠামোর মাধ্যমে অর্থাৎ বয়স অনুসারে জনসংখ্যার বণ্টন হতে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা এবং নির্ভরশীল জনসংখ্যা জানা যায়। তাছাড়া সমগ্র জনসংখ্যা এবং জনশক্তির অনুপাত জানা যায়। বাংলাদেশে ১৯ বছরের নিচে জনসংখ্যা বেশি। অর্থাৎ এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সে অনুপাতে শ্রমশক্তি বাড়েনি ।
৫. শিক্ষার হার: শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড, কিন্তু উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিক্ষার হার খুবই কম। এদেশের বেশির ভাগ লোক নিরক্ষর, অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে সকল বয়সী লোকের শিক্ষার হার ৩২.৪%। যেখানে পুরুষ শিক্ষার হার ৩৮.৯% এবং নারী শিক্ষার হার ২৫.৫%। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী শিক্ষার হার ৬৪%। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী শিক্ষার হার যুক্তরাজ্যে ৯৯%, যুক্তরাষ্ট্রে ৯৮%, জাপানে ৯৮%, শ্রীলংকায় ৭৮% ও মায়ানমারে ৬৫%। বাংলাদেশেও বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি নারী শিক্ষার হারও অনেক বেড়েছে।
৬. জন্মহার ও মৃত্যুহার: বাংলাদেশে জনসংখ্যায় জন্মহার ও মৃত্যুহার দুই-ই খুব বেশি। তবে ১৯৫০ সাল থেকে স্বাস্থ্য সুবিধা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য মৃত্যুহার কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে। এদেশে জন্মহার এবং মৃত্যুহার শহর অপেক্ষা গ্রামাঞ্চলে বেশি। শিক্ষার অভাব, চিকিৎসার অভাব, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, দারিদ্র্যতা ইত্যাদি এর জন্য দায়ী। উন্নত দেশে জন্মহার যেখানে প্রতি হাজারে ১০ জন, সেখানে বাংলাদেশে জন্মহার ১৭.৯ জন (২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। উন্নত দেশের মৃত্যুহার যেখানে প্রতি হাজারে অনধিক ২ জন, সেখানে বাংলাদেশের ২০০১ সালে- আদমশুমারি অনুযায়ী প্রতি হাজারে মৃত্যুহার ৩.৮ জন।
আরো পড়ুনঃ গ্রামীণ বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা আলোচনা কর।
৭. আয়ুষ্কাল: “বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১১ এ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের গড় আয়ুষ্কাল ৬৮.৬ বছর। তন্মধ্যে পুরুষের গড় আয়ুষ্কাল ৬৬.৮ এবং মহিলাদের ৭০ বছর। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এ প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের গড় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর এবং ব্রিটেনের জনগণের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ৭২ বছর । তবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল পূর্বের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।
৮. বেশিরভাগ লোক গ্রামে বাস করে: কোনো দেশের জনসংখ্যার গ্রাম ও শহরভিত্তিক বণ্টনের চিত্র থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা নেওয়া যায়। সাধারণত উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ শহরে বাস করে। যেখানে ইংল্যান্ড ৭৬%, আমেরিকায় ৭৪%, ফ্রান্সে ৭৮% এবং জাপানে ৭৬% লোক শহরে বাস করে, সেখানে বাংলাদেশে ২০% লোক শহরে বাস করে অর্থাৎ, ৮০% লোকই গ্রামে বাস করে ।
৯. নির্ভরশীল জনসংখ্যার আধিক্য: ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৫-৫৯ বছর বয়সের মোট জনসংখ্যার ৪৯.৫%, বাকি ১৫ বছরের কম বয়স্ক শিশুর পরিমাণ মোট জনসংখ্যার ৪৫.১% এবং ৬০ বছর বয়স্ক মানুষের পরিমাণ ৫.৪%। অর্থাৎ, ৫০.৫% মানুষ নির্ভরশীল এবং ৪৫.৫% মানুষ উপার্জনে সক্ষম। যেখানে অন্যান্য দেশের নির্ভরশীলতার হার অত্যন্ত কম।
১০. নিম্ন মানব উন্নয়ন: বাংলাদেশের জনসংখ্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কারমুক্ত মানসিকতা ও সার্বিক দক্ষতার বিবেচনায় অনগ্রসর। মানব উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতাকে বৃদ্ধি করা যায়। UNDP এর Human Development Report ২০১১ এ অন্তর্ভুক্ত ১৭৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩ তম। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ নিম্ন মানবসম্পদ উন্নয়নভুক্ত দেশের অন্তর্গত। তবে অতি সম্প্রতি রিপোর্টে বাংলাদেশ নিম্ন হতে মধ্যম মানবসম্পদ উন্নয়ন গোত্রভুক্ত হয়েছে।
১১. দুর্বল জনস্বাস্থ্য: বাংলাদেশের জনসংখ্যার গড় স্বাস্থ্য প্রত্যাশিত নয়। দেশের শ্রমশক্তি সরবরাহ করে জনসংখ্যা যে কারণে সুস্থ, স্বাস্থ্যবান জনশক্তি একান্তই কাম্য। বাংলাদেশে মাথাপিছু চিকিৎসা খরচ ধরা হয়েছে বাৎসরিক ২২৫ টাকা। এ সামান্য টাকা ব্যয় বরাদ্দ দিয়ে একটি স্বাস্থ্যবান জাতি কল্পনা করা যায় না। তাছাড়া, এ খাতের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বরাদ্দকৃত সামান্য ব্যয় সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায় না।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায়সমূহ আলোচনা কর।
১২. তরুণ জনসংখ্যার আধিক্য: বাংলাদেশে ০-২৫ বছর বয়সীদের মোট জনসংখ্যার ৬০%। কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত বেশি হলেও, তাদের দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব রয়েছে। যুব জনগোষ্ঠীর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো দেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার গঠন ও কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য হতে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। কারণ বাংলাদেশে মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার বেশি, শিক্ষার হার কম, শ্রমশক্তি কম যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় প্রতিবন্ধক ।