অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা কর। এ পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
ভূমিকা: অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগ। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের সময় তিনি প্রস্তাব দেন, যাতে বাংলাকে একটি সার্বভৌম এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এই পরিকল্পনা ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে একটি অভিন্ন বাংলা গঠনের প্রয়াস। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারেনি নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণের কারণে।
অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা:
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগ: অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গৃহীত হয়। তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে প্রস্তাব করেছিলেন যে, বাংলাকে একটি স্বতন্ত্র এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা উচিত, যেখানে হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারবে।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে আলোচনা: ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল, দিল্লিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে সোহরাওয়ার্দী এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে তিনি দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সার্বভৌম যুক্ত বাংলার প্রস্তাব ঘোষণা করেন।
হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য অভিন্ন রাষ্ট্র: সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের জন্য একটি অভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলার মানুষ ধর্মীয় বিভেদের উর্ধ্বে গিয়ে একত্রে বসবাস করতে পারবে এবং একত্রে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।
‘বৃহৎ বঙ্গ’ পরিকল্পনা: এই পরিকল্পনাকে ‘বৃহৎ বঙ্গ পরিকল্পনা’ বা ‘অখণ্ড বাংলা পরিকল্পনা’ বলা হয়। এতে বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের জনগণ একত্রিত হয়ে একটি অভিন্ন বাংলার অংশ হবে এবং এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ঐক্য বজায় থাকবে।
স্বায়ত্তশাসনের ধারণা: অখণ্ড বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সেখানে হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই নিজেদের স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করবে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে তারা নিজস্ব শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করবে।
অখণ্ড বাংলা গঠনের পরিকল্পনার ব্যর্থতার কারণসমূহ:
সাংগঠনিক দুর্বলতা: এই পরিকল্পনার উদ্যোক্তাদের মধ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। সোহরাওয়ার্দী কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের নেতাদের একত্রিত করতে ব্যর্থ হন, ফলে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব: বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এই প্রস্তাব কার্যকর করা যায়নি। উভয় দলের নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভেবে এই পরিকল্পনার পক্ষে মত দেননি।
হিন্দু নেতাদের বিরোধিতা: শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী এবং অন্যান্য হিন্দু নেতারা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা মনে করতেন, অখণ্ড বাংলার মাধ্যমে মুসলিম লীগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং হিন্দুদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জনসংখ্যার বিভাজন: পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু এবং পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি থাকায় হিন্দু নেতাদের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করছিল। তারা কলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা: ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে’ কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গার পর হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটে, যা অখণ্ড বাংলার স্বপ্নকে ভেঙে দেয়।
কংগ্রেস হাইকমান্ডের বিরোধিতা: কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা, বিশেষত জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল, এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তারা মনে করতেন, এটি মুসলিম লীগের আধিপত্য বিস্তারের একটি কৌশল। তাদের এই বিরোধিতার ফলে প্রস্তাবটি সফল হয়নি।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নীরবতা: যদিও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে এই প্রস্তাব নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তার নীরবতা প্রস্তাবের সফলতা ব্যাহত করে।
হিন্দু নেতাদের বিচ্ছিন্নতাবোধ: বাংলার হিন্দু নেতারা মুসলমানদের শাসনের মধ্যে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। তারা পশ্চিম বাংলাকে ভারতের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বহীনতা: যদিও কমিউনিস্ট পার্টি অখণ্ড বাংলার পক্ষে ছিল, তারা এই প্রস্তাবের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। তাদের অবহেলা পরিকল্পনার সফলতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
ব্রিটিশ সরকারের অনিচ্ছা: ব্রিটিশ সরকার এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেনি। তারা ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্তে অটল ছিল এবং অখণ্ড বাংলার ধারণাকে তারা সমর্থন দেয়নি।
উপসংহার: অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ছিল সোহরাওয়ার্দীর একটি সাহসী পদক্ষেপ। তবে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংগঠনিক নানা বাধার কারণে এটি বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তবুও, এটি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
