রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদটি আলোচনা কর।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদটি আলোচনা কর।

সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশের ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই মতবাদের মূল বক্তব্য হলো, রাষ্ট্রের উদ্ভব একটি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে ঘটেছে। প্রাক-রাষ্ট্রীয় সমাজে মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করত, কিন্তু বিশৃঙ্খলা ও সংঘাতের কারণে তারা একটি শৃঙ্খলিত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই তত্ত্বটি টমাস হবস, জন লক এবং জঁ-জাক রুসোর মতো চিন্তাবিদদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল বিষয়বস্তু 

১. প্রাক-রাজনৈতিক অবস্থা: সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুসারে, রাষ্ট্রের পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। সেখানে আইন বা শাসনের অস্তিত্ব ছিল না। টমাসের মতে, এটি ছিল “যুদ্ধাবস্থার” যুগ। জন লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে শান্তি ও স্বাধীনতা ছিল, তবে আইন কার্যকর ছিল না। রুসো মনে করেন, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ সমান এবং নির্ভরশীল ছিল।

২. প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি: প্রাকৃতিক অবস্থার বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা এবং অধিকার লঙ্ঘনের ফলে মানুষ একটি সংগঠিত সমাজের প্রয়োজন অনুভব করে। ফলে তারা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। 

সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রধান প্রবক্তারা এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি

 ১. টমাস হবসের মতবাদ (Leviathan): টমাস হবস প্রাকৃতিক অবস্থাকে “সবাই সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি মনে করেন প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল বিশৃঙ্খল, নিষ্ঠুর, এবং সংক্ষিপ্ত। মানুষের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার অভাবের কারণে, তারা একটি সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে নিজেদের প্রাকৃতিক অধিকার হস্তান্তর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় সার্বভৌম শাসক গঠিত হয়, যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। হবসের মতে, এই শাসক নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী এবং তার আদেশই আইনের চূড়ান্ত ভিত্তি।

২. জন লকের মতবাদ: জন লক প্রাকৃতিক অবস্থাকে শান্তিপূর্ণ এবং যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করতেন। তবে তিনি স্বীকার করেন যে ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে মাঝে মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হতো। এর ফলে মানুষেরা নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। লকের মতে, রাষ্ট্র যদি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করে, তবে জনগণ সরকার পরিবর্তন করতে পারে।

৩. জঁ-জাক রুসোর মতবাদ (The Social Contract): রুসোর মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ সমান, স্বাধীন এবং শান্তিপূর্ণ ছিল। তবে সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে অসমতা ও সংঘাত সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা সমাধানে মানুষ একটি সার্বভৌম চুক্তি করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।  তিনি বিশ্বাস করেন যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা জনগণের সাধারণ ইচ্ছার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং এটি ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে সমষ্টিগত কল্যাণে কাজ করবে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের বৈশিষ্ট্য

১. স্বেচ্ছায় চুক্তি: সামাজিক চুক্তি জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে গঠিত হয়। এটি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের একটি মৌলিক ভিত্তি।

২. প্রাকৃতিক অধিকারের সমর্পণ: মানুষ তাদের কিছু প্রাকৃতিক অধিকার রাষ্ট্রকে প্রদান করে। তবে রাষ্ট্রের মূল কাজ হলো এই অধিকার রক্ষা করা।

৩. শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা: রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

৪. গণকল্যাণের ধারণা: রুসোর মতে, রাষ্ট্র জনগণের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন। এটি সমষ্টিগত কল্যাণে কাজ করে এবং সকল নাগরিক সমানভাবে উপকৃত হয়।

৫. সার্বভৌমত্বের ধারণা: রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি আইনের শাসনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

৬. আইনের শাসন: আইনের শাসন সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এটি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রভাব

১. গণতন্ত্রের বিকাশ: এই তত্ত্ব আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছে। এটি জনগণের ইচ্ছাকে শাসনের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

২. ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা: সামাজিক চুক্তি ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকারের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

৩. আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি: এই মতবাদ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি তৈরি করেছে। এটি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করেছে।

৪. আইন এবং শাসনের গুরুত্ব: আইনের শাসনের ধারণা এই তত্ত্বের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান অধিকার এবং দায়িত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

৫. সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি: এই তত্ত্বে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচনা

১. ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব: সামাজিক চুক্তি মতবাদের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এটি কেবল একটি কাল্পনিক ধারণা।

২. বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন: সমালোচকদের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থা এবং চুক্তির ধারণা বাস্তবসম্মত নয়।

৩. সমাজের জটিলতা উপেক্ষা: এই তত্ত্ব সমাজের বহুমুখী বাস্তবতা এবং ক্ষমতার বিভাজনকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ।

৪. সর্বজনীন চুক্তি: পরবর্তী প্রজন্মকে এই চুক্তির বাধ্যবাধকতার মধ্যে আবদ্ধ থাকার যুক্তি অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য।

৫. স্বৈরাচারী শাসনের ঝুঁকি: হবসের মতে সার্বভৌম ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এটি স্বৈরাচারে পরিণত সম্ভাবনা থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এটি মানুষের স্বাধীনতা, সমতা, এবং রাষ্ট্রের শৃঙ্খলিত কাঠামোর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। যদিও তত্ত্বটি সমালোচিত, তবে এটি আধুনিক গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। টমাস হবস, জন লক এবং রুসোর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এই তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছে। সামাজিক চুক্তি মতবাদ আজও রাষ্ট্র ও সমাজের বিকাশ এবং সম্পর্কের বিশ্লেষণে প্রাসঙ্গিক ধারণা প্রদান করে।

Share your love
Shihabur Rahman
Shihabur Rahman

Hey, This is Shihabur Rahaman, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 927

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *