প্রশ্নঃ সমাজকর্মের সাথে সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক নিরূপণ করো।
ভূমিকা: সমাজের বিজ্ঞানই হলো সমাজবিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞান সমাজকে পূর্ণাঙ্গভাবে পর্যালোচনা করে এবং সমাজের ক্রমবিকাশের ধারা ও সমাজের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বরূপ বর্ণনা করে। সমাজকর্ম সমাজসেবার সুসংগঠিত ব্যবস্থাকে নিয়ে আলোচনা করে। সামাজিক মানুষের কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করাই এর মূল উদ্দেশ্য। অপরদিকে, মনোবিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্ববিদ্যা হল, মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণ সম্পর্কিত বিদ্যা ও অধ্যয়ন। এটি বিজ্ঞানের একটি তাত্ত্বিক ও ফলিত শাখা যাতে মানসিক কর্মপ্রক্রিয়া ও আচরণসমূহ নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করা হয়। নিচে এদের সম্পর্ক আলোচনা করা হলোঃ
সমাজকর্মের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক
সমাজকর্ম একটি সমন্বয়ধর্মী সমাজবিজ্ঞান। সমাজ জীবনের সার্বিক দিকের উন্নতিই সমাজকর্মের লক্ষ্য। তাই মানবজীবনের সামগ্রিক দিক অর্থাৎ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, দৈহিক, মানসিক ইত্যাদি দিকের উন্নতি করতে হলে সমাজকর্মীকে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান হতে জ্ঞান আহরণ করতে হয়। তবে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান হতে জ্ঞান আহরণ করলেও সমাজকর্ম নিজেকে একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আরো পড়ুনঃ কিশোর অপরাধ কি? কিশোর অপরাধের কারণ গুলো আলোচনা কর।
১. সংজ্ঞাগত: সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞানই হল সমাজবিজ্ঞান, যা সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যয়ন করে। অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞান প্রথা ও প্রতিষ্ঠান এবং এদের পেছনে যেসব বিষয় ও ধারণা কাজ করছে সে সম্পর্কে আলোচনা করে এবং সমাজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান দান করে। অন্যদিকে, সমাজকর্ম এমন একটি সামাজিক বিজ্ঞান ও পেশা, যা সামাজিক সমস্যা সমাধান করে সমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনে সহায়তা করে। সমাজকর্মের লক্ষ্য অর্জনের জন্য একজন সমাজকর্মীকে সামাজিক সমস্যা, সামাজিক কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রথা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে হয়। তাই বলা যায়, উভয়ের আলোচ্যবিষয় এক এবং এ বিবেচনায় উভয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।
২. লক্ষ্যগত: সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম উভয়ের লক্ষ্য সমাজের কল্যাণ ও প্রগতি নিশ্চিত করা। আর এ লক্ষ্য অর্জনে সমাজবিজ্ঞান সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করে। অন্যদিকে, সমাজকর্ম সমাজবিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞানকে পুঁজি করে সামাজিক সমস্যার সমাধান দিয়ে সমাজের উন্নতি বিধানে সক্ষম হয়। তাই আমরা বলতে পারি, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম একে অন্যের পরিপূরক।
৩. বৈশিষ্ট্যগত: সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য হল সমাজ সম্পর্কিত সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যান্য সমাজবিজ্ঞান সমাজের এক একটি দিক নিয়ে আলোচনা করলেও সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম সমাজের সামগ্রিক দিক নিয়ে আলোচনা করে। সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্মের এসব বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকেও এরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।
৪. সাদৃশ্যগত: সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্মের আলোচ্যবিষয় সমাজ বলে অনেকে এ দু’টি বিষয়কে একই মনে করে থাকেন। অনেকের মতে, সমাজবিজ্ঞান তাত্ত্বিক দিক এবং সমাজকর্ম ব্যবহারিক দিক নিয়ে ব্যাপৃত। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্মের মধ্যে সাদৃশ্যগত সম্পর্ক গভীর।
৫. গঠনগত: সমাজ সম্পর্কিত মৌলিক ও বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জন ছাড়া সমাজকর্ম তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। আর এক্ষেত্রে মৌলিক ও বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জনে প্রয়োজন সমাজবিজ্ঞান। তাই আমরা বলতে পারি, সমাজকর্মের জ্ঞানের মৌলিক উৎস হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের সাথে এর সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
আরো পড়ুনঃ কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী আলোচনা কর।
৬. উদ্দেশ্যগত: সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য যেসব উন্নয়ন প্রচেষ্টা নেওয়া হয়, তার জন্য সমাজস্থ মানুষের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, প্রেষণা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ইত্যাদি জানতে হয়। এরই ভিত্তিতে সমাজকর্মীরা সার্বিক কল্যাণ সাধন করতে পারেন। তবে এসব বিষয়ে জানতে হলে সমাজবিজ্ঞানের সাহায্য প্রয়োজন। এদিক থেকেও সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম সম্পর্কযুক্ত। সমাজবিজ্ঞান সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান দান করে এবং সমাজকর্ম তা নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতির মাধ্যমে মানব কল্যাণে প্রয়োগ করে। অর্থাৎ, একটি ছাড়া অন্যটি চলতে পারে না।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্মের মধ্যে একদিকে যেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান অন্যদিকে, তেমনি কিছু পার্থক্যও বিদ্যমান। উভয়ই যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একটি ছাড়া অন্যটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না।
সমাজকর্মের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক
সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সমাজকর্ম নিয়ে কাজ করতে গেলে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান একান্ত অপরিহার্য। এমনিভাবে সমাজকর্ম নানাদিক দিয়ে মনোবিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল।
১. সংজ্ঞাগত: সমাজকর্ম মানুষকে তার নিজস্ব সম্পদ ও সামর্থ্য ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে তোলে এবং পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে চলতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, মনোবিজ্ঞান প্রাণী ও মানুষের আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ, মানুষ কোন পরিস্থিতিতে কি রকম আচরণ করে তা নিয়ে আলোচনা করে। এ থেকে বুঝা যায়, সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞান উভয়ই মানুষের কল্যাণকে ঘিরেই কাজ করে। এদিক থেকে উভয়ে সম্পর্কিত।
২. সামঞ্জস্যগত: সমাজকর্ম মানুষকে পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সামাজিক ভূমিকা পালন করতে সহায়তা করে। আর এ জন্য মানুষের প্রেষণা, বুদ্ধি, আবেগ, ব্যক্তিত্বের কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয়, যা মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে সম্ভব। এ বিবেচনায় সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞান পরস্পর সম্পর্কিত।
৩. লক্ষ্যগত: সমাজকর্ম মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে সমস্যার কারণ, উৎস, প্রকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হয়। এ কথা সর্বজনবিদিত, সকল সমস্যার মূলে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক কারণ। অতএব, সমস্যার বিশ্লেষণ করতে হলে সমাজকর্মীকে মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়। অর্থাৎ, সমাজকর্ম মনোবিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল।
আরো পড়ুনঃ মাদকাসক্তি কি? এ সমস্যার সমাধানে একজন সমাজকর্মীর ভূমিকা আলোচনা কর।
৪. ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যীকরণে: সমাজকর্ম ব্যক্তি স্বাতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে সমাজের কল্যাণে কাজ করে। কেননা, সমাজকর্মে বিশ্বাস করা হয়, প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আর এ জন্য সমাজকর্মী সমাজকর্মের পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে তা করতে গিয়ে তাকে মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়।
৫. প্রতিভা বিকাশে: সমাজকর্ম মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তাকে স্বাবলম্বী করতে চায়। আর এ জন্য ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করতে হয়। কেবল মনোবিজ্ঞানের সাহায্যেই তা সম্ভব। এ বিবেচনায় সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত।
৬. ক্ষেত্রগত: সমাজকর্ম শিশুকল্যাণ, শ্রমকল্যাণ, স্কুল সমাজকর্ম, চিকিৎসা সমাজকর্ম ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, শিল্প মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের সাহায্য নেয়। এ অর্থে সমাজকর্ম ও মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত।
৭. মনস্তাত্ত্বিক: সমাজকর্ম মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। সমাজকর্ম মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান ও তত্ত্ব বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে মানবকল্যাণে প্রয়োগ করে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে পরিপূর্ণতা দান করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, সমাজকর্ম একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান। অন্যদিকে, মনোবিজ্ঞান বহুলাংশে মৌলিক বিজ্ঞানের অন্তর্গত। উপরিউক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সমাজ জীবনের সামগ্রিক উন্নয়নে সামাজিক উত্তেজনা হ্রাস, জাতি ও বর্ণগত বৈষম্য দূরীকরণ, সামাজিক সংহতি ও ঐক্য বজায় রাখতে এবং মানুষের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করার জন্য, সমাজকর্মীদের মনোবিজ্ঞান ও এর বিভিন্ন শাখার জ্ঞানার্জন করতে হয়। জ্ঞানের প্রতিটি শাখা একটির সাথে আরেকটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। এগুলো মূলত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই একটি জানলে আরেকটি জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়।
অসাধারণ লেখা