প্রশ্নঃ কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ কল্যাণ রাষ্ট্র সর্বজনীন কল্যাণ সাধনের জন্য বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে থাকে। এটি নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং রাষ্ট্রের জনসাধারণ কে জনসম্পদে রূপান্তর করার মত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কল্যাণ রাষ্ট্রঃ কল্যাণ রাষ্ট্র হলো এমন একটি বৈশ্বিক ধারণা যেখানে সর্বাবস্থায় মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করা হয় । কল্যাণ রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে।
কল্যাণ রাষ্ট্রের সংজ্ঞাঃ সাধারন অর্থে যে রাষ্ট্র মানব কল্যাণ করে তাই কল্যাণ রাষ্ট্র। অন্যভাবে বলতে গেলে, যে রাষ্ট্র নাগরিকদের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করে তাই কল্যাণ রাষ্ট্র।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ Arther Sebirger-এর মতে, “কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি ব্যবস্থা যে ব্যবস্থায় সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত নাগরিকের জন্য একটি নির্দিষ্টতা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কর্মসংস্থান, আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধাদানে সম্মত হয়।”
সমাজবিজ্ঞানী T.W. Kent-এর মতে, “কল্যাণরাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য ব্যাপক সমাজসেবার ব্যবস্থা করে।”
আরো পড়ুনঃ সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি কি?
Barker বলেন, “কল্যাণরাষ্ট্র হলো এমন একটি জাতি বা সমাজ যে রাষ্ট্র জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা পূরণে নিজে দায়বদ্ধ।”
United Nations organization (UNO) প্রদত্ত সংস্থানুযায়ী, “সব রাষ্ট্রই আবার কল্যাণ রাষ্ট্র নয়, সকল রাষ্ট্রকে কল্যাণ রাষ্ট্র বলা যায় না। একটা রাষ্ট্রকে তখনই কল্যাণ রাষ্ট্র বলা হবে যখন রাষ্ট্রের জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও পড়ার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, বেকারত্ব, অসুস্থতা, যেকোন ধরনের অক্ষমতা ব্বৈম্য বা অন্য কোনো কারণে জীবিকা নির্বাহে ব্যক্তি অনুপযুক্ত হলে তাকে সার্বিক সহায়তা করা হয় তখনই সে রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে।
সর্বোপরি, কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে সরকার তার নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ রক্ষা ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি নাগরিকদের সমৃদ্ধি জন্য অক্ষমের সুযোগের সমতার ভিত্তিতে, সম্পদের সমানুপাতিক বণ্টন এবং জনগণের দায়বদ্ধতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেঅথ
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যাবলি:
রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রতিটি নাগরিকের সুখী ও সমৃদ্ধশালীল জীবনযাপনের জন্য কল্যাণরাষ্ট্র বহুবিধ কার্য সম্পাদন করে থাকে। নিম্নে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যাবলি আলোচনা করা হলোঃ
আরো পড়ুনঃ গ্রামীণ সমাজসেবা কি? বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম গুলোর বর্ণনা দাও।
জনকল্যাণ সাধনঃ কল্যাণ রাষ্ট্রের দাবিদার সকল রাষ্ট্রের কাজের মানদণ্ড হল জনকল্যাণমূলক কাজ করা। রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনসাধারণের সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কল্যাণ করা। জনকল্যাণের সাথে রাষ্ট্র নাগরিকদের ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ন্ত্রণ করে।
নাগরিকদের নিরাপত্তা দানঃ রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করে। প্রতিরক্ষা বাহিনী নাগরিকদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত থাকে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ কল্যাণ রাষ্ট্র অবশ্যই যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে। জনগণের উপযোগমূলক সেবা, যেমন রাস্তাঘাট, ব্রীজ, সেতু, রেল, ডাক, টেলিগ্রাফ টেলিফোন, বেতার, টিভি ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও আকাশযান হিসেবে এরোপ্লেন, উড়োজাহাজ ব্যবস্থা থাকে।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দানঃ অর্থনৈতিক দিক থেকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেও বাস্তবায়ন করে থাকে। এজন্য রাষ্ট্র বেকারভাতা, বয়স্ক ভাতা ও বিভিন্ন ধরনের রেশনের ব্যবস্থা করে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরঃ রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে সকল রকম অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এক্ষেত্রে ধনী-গরিবের মধ্যকার বৈষম্য দূর করতেও পরিকল্পনা করা হয়।
জীবনযাত্রার মান উন্নয়নঃ রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করে। এজন্য রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মান উন্নয়নে কাজ করে। কেননা মৌলিক চাহিদার উন্নয়ন হলে জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হয়।
শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাঃ যে কোন কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ হল শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা । কল্যাণ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা জোরদার করে। বৈদেশিক শক্তির আগ্রাসন ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে নিজস্ব ভূমি রক্ষার ক্ষমতা অর্জন করে। এ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পুলিশ ব্যবস্থা, আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে।
আরো পড়ুনঃ কিশোর অপরাধ কি? কিশোর অপরাধের কারণ গুলো আলোচনা কর।
স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠাঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সকল শ্রেণি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গণস্বার্থ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে । স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। তাই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখে।
প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণঃ নাগরিকের মঙ্গলের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করবে। প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করবে। সম্পদের অপব্যয় রোধকল্পে নাগরিকদের সচেতনতা সৃষ্টি করবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নঃ প্রতিটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল মন্ত্র হলো শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নত করতে পারে না। এ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শিক্ষাকে সর্বাধিকার দিয়ে দেশের সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কলেজ, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ।এছাড়াও শিক্ষার পর্যাপ্ত ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়।
চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থাঃ কল্যাণ রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে নাগরিকদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করে। বিনোদন ব্যবস্থা হিসেবে পার্ক, মিউজিয়াম, লাইব্রেরী, মাঠ ইত্যাদি স্থাপন করে থাকে। প্রতিভার বিকাশের জন্য ধর্মীয় আলোচনা সভা, বাসার শালীনতা সম্পন্ন চলচিত্র, নাটক ও সংঙ্গীত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে।
অক্ষম বৃদ্ধ এবং সুবিধাবঞ্চিতদের সেবা প্রদানঃ সমাজের হতদরিদ্র সুবিধা বঞ্চিত বৃদ্ধ ও অক্ষম-ব্যক্তিদের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্র বিভিন্ন কর্মসূচী, ভাতা ও বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা করে।বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ব্যক্তিদের কর্মক্ষম করে তোলে । রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র সর্বদা তৎপর থাকে।
জনগণের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নঃ প্রতিটি কল্যাণ রাষ্ট্রের সকল জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করে । রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীপেশার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান এবং সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা প্রদান সহ নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করতে কাজ করে।
আরো পড়ুনঃ কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী আলোচনা কর।
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাঃ কল্যাণ রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই যেন ন্যায় বিচার পায় রাষ্ট্র সেই লক্ষ্যে কাজ করে। প্রতিটি কল্যাণ রাষ্ট্রে সকল নাগরিক আইনের চোখে সকলে সমান বলে বিবেচিত হয়।
শ্রম সংস্থান ও শ্রম আইনঃ কল্যাণ রাষ্ট্র শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণের জন্য শ্রম-আইন প্রণয়ন করে। শ্রমিকদের নির্যাতন ও বঞ্চনা প্রতিরোধের জন্য শ্রম সংস্থা গঠন করে। শ্রমিকরা যেন তাদের সিদ্ধান্ত ও মতামত নির্ভয়ে বলতে পারে সেই পরিবেশ তৈরী করার লক্ষ্যে কাজ করে।
কুটির শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত কুটির শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। কুটির শিল্পসমূহকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নানা সময় নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কৃষিক্ষেত্রে অবদানঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের উৎসাহ প্রদান করে থাকে।পাশাপাশি বিভিন্ন সময় সরকারিভাবে বিভিন্ন ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের সেক্ষেত্রে কল্যাণ সাধনে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
সামাজিক সমস্যার সমাধানঃ যেকোনো সামাজিক সমস্যার সমাধান করাও কল্যাণ রাষ্ট্রের একটি অন্যতম কাজ। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে পতিতা বৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, দরিদ্রতা, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা ইত্যাদি সমস্যা সমূহ পরিলক্ষিত হয়। এসব সমস্যার যুগোপযোগী সমাধানে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে।
আরো পড়ুনঃ মাদকাসক্তি কি? এ সমস্যার সমাধানে একজন সমাজকর্মীর ভূমিকা আলোচনা কর।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও কল্যাণমূলক কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। সুতরাং, জনকল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক ও সুপরিকল্পিত কার্যাবলি সম্পাদন করাই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ।