বাংলাদেশের সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি

 প্রশ্নঃ বাংলাদেশের সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি আলোচনা কর। 

earn money

ভূমিকাঃ একটি ঐতিহ্যবাহী সমাজ হিসেবে বাংলাদেশী সমাজের সামাজিক ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো। ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত এখানকার অর্থনীতি ও সমাজজীবন ছিল বেশ সমৃদ্ধ। এখানে বিদ্যমান ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বাংলা সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন শাসক বারবার আক্রমণ করেছে, লুন্ঠন করে এখানকার সম্পদ। আবার ব্যবসা বাণিজ্যকে আশ্রয় করে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে। অতীতে এখানকার সংস্কৃতি বিশ্বের অনেক জাতির কাছে ছিল অনুকরণীয়।

বাংলাদেশের সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিঃ বর্তমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে উন্নী মেয়েও একটি বর্ণাতা ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হতে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে নিম্নে ঐতিহাসিক বিবর্তনের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। 

আরো পড়ুনঃশ্রেণী ও জাতি বর্ণের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করো? 

১. প্রাক-ব্রিটিশ আমলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি: বাংলা বলতে প্রাচীনকাল থেকে চৌদ্দশত সাল পর্যন্ত এবং ইলিয়াসশাহী শাসনামল পর্যন্ত সুবিস্তৃত যে ভূখণ্ড ছিল তাকেই বুঝাত। ‘বাঙ্গালা’ বা ‘বাংলা’ নামটি মুসলমান আমলে প্রচলিত হয়। ইতোপূর্বে বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে পাল বংশ, সেন বংশ তাদের পূর্ব যুগে বাংলার বিভিন্ন নাম ছিল। যেমন- পূত্র, বরেন্দ্র, সুক্ষ্ম, রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, গৌড় এবং লক্ষণাবতী বা লখনৌতি। এগুলো প্রাচীন সরলপদ হিসেবে পরিগণিত। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস তার সর্বপ্রথম সমগ্র জনপদ এ শাসনাধীনে এনে স্বাধীন বাঙ্গালা প্রতিষ্ঠা করেন।

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


২. মধ্যযুগে বাংলার অবস্থা: ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি সর্বপ্রথম বাঙ্গালায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্, সিকান্দার শাহ, গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ্, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ প্রমুখ সুলতান বঙ্গদেশ শাসন করেন। মুঘল আমলে নিযুক্ত সুবেদারগণও এদেশ পরিচালনা করেন। ইসলাম খাঁ, মীর জাফর, শায়েস্তা খান, প্রমুখ এদেশ শাসন করেন। এসব সুলতান ও সুবাদাররা এদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক প্রভৃতি দিকে উৎকর্ষ সাধন করেন এবং সমাজ প্রজাকল্যাণে ব্যাপক অবদান রাখেন। 

৩. ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশ: বঙ্গভূমির অতুল ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়ে একদিন অন্যান্য জাতির মতো ইংরেজরাও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করে। ১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে মহারানী এলিজাবেথের কাছে থেকে Royal Charter এবং ১৬১৩ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি লাভ করে। পরে বাংলার সর্বত্র বাণিজ্য কুঠি ও দুর্গ নির্মাণ করে ব্যাপকভাবে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের সুচতুর পরিকল্পনার মাধ্যমে বণিক থেকে শাসক বনে যায়। পলাশির যুদ্ধের মাধ্যমে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে কোম্পানি চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এ যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ম্যাসিলন বলেন, “পলাশির যুদ্ধের মতো আর কোনো যুদ্ধের ফলাফল এত প্রত্যক্ষ, এত বিশাল ও এত স্থায়ী হতে দেখা যায়নি।”

‘পলাশির যুদ্ধে ভারতবর্ষের দুর্বলতা প্রকাশিত হয় এবং ইংরেজ প্রভাব ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বাংলার সংকট সৃষ্টি হয়, কোম্পানির প্রাধান্য বিস্তৃত হয়, ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয় সুনিশ্চিত হয়, অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বিতাড়িত হয়, কোম্পানি বাণিজ্যিক অধিকার ও সম্পদ অপহরণ করে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ পায়, কোম্পানি ও কর্মচারীরা লুণ্ঠন শুরু করে। এরপর নিম্নোক্ত ঘটনাগুলো ঘটে:

আরো পড়ুনঃইসলামী সংস্কৃতি কী? ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভ লেখ

  • ১৭৫৭ সালের পর থেকে ইংরেজ প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।
  • ১৭৭২ সালে চূড়ান্তভাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। 
  • ভারতবর্ষের জনসাধারণের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন হয় 
  • ১৮৫৭ সালে সিপাহিবিদ্রোহ সংঘটিত ও ইংরেজরা জয়ী হয়। 
  • দেশের ভাষা, শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম, রীতিনীতি, আচার-প্রথা প্রভৃতিতে পাশ্চাত্য ও আধুনিকতার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
  • কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং গ্রামাঞ্চলে চুরি-ডাকাতি বৃদ্ধি পায়।
  • কোম্পানির নিযুক্ত কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি বাসা বাঁধে।
  • ভারতের প্রধান দু’সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বৈরিতা শুরু হয় এবং দাঙ্গা বেঁধে যায়।
  • মুসলমানদের অবস্থার অবনতি ঘটে।
  • ব্রিটিশ ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হয় এবং ইংরেজি ভাষার প্রচলন হয়।
  • বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। 
  • ভূমি রাজস্বের চাপ বাড়ে।
  • আন্দোলন সংগ্রাম ও বিপ্লব পরিচালিত হয় এবং ১৯০ বছর পর ইংরেজরা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।

৪. পাকিস্তান আমল: ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বর্তমান বাংলাদেশ ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের একটি অংশ যা পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণসমূহ নিম্নরূপ: 

  • পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে পদে পদে তাদের মুখাপেক্ষী করে রাখে। 
  • বাঙালিদেরকে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুপ্রবেশ থেকে বঞ্চিত রাখে।
  • রাজনীতি ও প্রশাসন যন্ত্রকে নিজেদের কব্জা করে রাখে।
  • পশ্চিম পাকিস্তানিরা উপনিবেশবাদী মনোভাবের কারণে সুপরিকল্পিতভাবে সামরিক/প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে বাঙালিদের দূরে রাখে।
  • অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যনীতি গ্রহণ করে বৈদেশিক সাহায্যের বণ্টন, রাজস্ব ব্যয়, শিক্ষা ব্যয়, সমাজকল্যাণসহ সকল ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্য পোষন করে।

৫. স্বাধীন বাংলাদেশ: ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মূলমন্ত্র ছিল মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হবে এবং অঙ্গরাজ্যগুলো স্বায়ত্তশাসিত হবে। কিন্তু পাকিস্তানিরা তা অমান্য করলে আসে ৫২, ৫৪, ৬৬, ৬৯, ৭০ এবং ৭১ সালের চূড়ান্ত বিজয়।

বাঙালিদের অধিকার স্বায়ত্তশাসন, সুযোগ সুবিধা আদায় ইত্যাদির প্রেক্ষিতে পরিচালিত সুদীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এ বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। মুজিব নগরে অস্থায়ী সরকার গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়। সুদীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

আরো পড়ুনঃচিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্যগুলো লেখ

 স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি রূপে গ্রহণ করে (৫ম ও ৮ম সংশোধনীতে কিছু পরিবর্তন ছাড়া) স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত ও দেশের অগ্রযাত্রা অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হয়। এরপর দেশ পুনর্গঠন, অবকাঠামোগত ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি বিস্তৃত হয়। পলি বা গ্রামোন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ বা জনকল্যাণ, সামাজিক নিরাপত্তা, শিশু, যুব, নারী, প্রখ্যণ ও শ্রমকল্যাণ, পরিবহন ও যোগাযোগ প্রভৃতিতে ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার সামাজিক ও অবস্থা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিশেষ করে ১৪০০ সালের সাংস্কৃতিক অবকন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আক্রমণ ও লুষ্ঠনের ফলে বাংলা তার স্বকীয় সামাজিক সাংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতির বসবাস ও স্থানীয় লোকজনের সাথে মিশ্রণের ফলে তৈরি হয়েছে সংকর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। তদুপরি একই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় বসবাসের ফলে সবাই পেয়েছে বাঙালি খেতাব।

Riya Akter
Riya Akter
Hey, This is Riya Akter Setu, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক