প্রশ্নঃ সমাজকর্ম কি? সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর? অথবা, বাংলাদেশে সমাজকর্মের বৈশিষ্ট সমূহ আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ সমাজকর্ম আধুনিক সমাজকল্যাণের একটি বিজ্ঞানসম্মত সাহায্যকারী পদ্ধতি। সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যা মোকাবিলায় সমাজকর্মের গুরুত্ব অত্যাধিক। বর্তমানে সমাজকর্ম সারা বিশ্বে পেশা হিসেবে স্বীকৃত। এটি সমাজ কল্যাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে বিবেচিত।
সমাজকর্মের সংজ্ঞাঃ সমাজকল্যাণের আধুনিক পরিশীলিত রূপ হল পেশাদার সমাজকর্ম। এটি এমন একটি সাহায্যকারী পেশার যা কতগুলো পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যক্তি, দল বা সমষ্টির সমস্যার সমাধানে এমনভাবে সহায়তা করে যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধানের সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা দলের পূর্ণ বিকাশ ও উন্নতি লাভ করা সম্ভব হয়।
UNO এর মতে, সমাজকর্ম এমন এক ধরনের কার্যাবলী যা ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে সমঞ্জস্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্কের সৃষ্টি দ্বারা তাদের সাহায্য করতে চায়।
আরো পড়ুনঃ কিশোর অপরাধ কি? কিশোর অপরাধের কারণ গুলো আলোচনা কর।
হার্বাট বিষ্ণু বলেন, সমাজকর্ম সেই সেবা ব্যবস্থা যা সমাজে পূর্ণ এবং কার্যকরী অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যেসব সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা বর্তমানে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আসতে পারে সেগুলো দূরীকরণে মানুষকে একক কিংবা দলীয়ভাবে সাহায্য করে থাকে।
সমাজ কল্যাণ অভিধানের ভাষায়, সমাজকর্ম হলো অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কৌশলের নৈতিক ও উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ যা ব্যক্তি দল বা প্রতিবেশীর কাঙ্ক্ষিত এবং সামাজিক কার্যক্রম জোরদার করার উদ্দেশ্য পরিচালিত হয়ে থাকে যা সকলের কল্যাণের জন্য সহায়ক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রয়োগিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়।
National Association of social workers (NASW) এর Board of Director 1970 সালে সমাজকর্মের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। NASW এর মতে, সমাজকর্ম ব্যক্তি দল ও সাহায্য করবে এক পেশাগত কর্মকাণ্ড যা তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালী করে এবং সামাজিক লক্ষ্য উপযোগী করে তোলে।
সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য
উপর যুক্ত সংজ্ঞা সমূহের আধুনিক সমাজকর্মের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। নিচে সংজ্ঞা সমূহের আলোকে সমাজকর্মের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো।
১। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ আধুনিক সমাজকর্মের দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞান নির্ভর। এখানে কুসংস্কারের কোন স্থান নেই। সমাজকর্ম মানুষের সমস্যার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা হয় এবং সমস্যার প্রেক্ষিতে বাস্তবসম্মত সমাধান দেওয়া হয়। আর যারা সমস্যার সমাধানে কাজ করে থাকেন তারা হলেন সমাজকর্ম। উন্নত দেশ তাদেরকে সামাজিক ডাক্তার বলা হয়।
আরো পড়ুনঃ বেকারত্ব কি? বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণের উপায় সমূহ বর্ণনা কর।
২। সংগঠিত সাহায্য দান পদ্ধতিঃ আধুনিক সমাজকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সুসংগঠিত সাহায্য দান পদ্ধতি। সমাজকর্ম সংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে সমাজের সকল মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সহায়তা করে থাকে। এ সু সংগঠিত সাহায্যদান প্রক্রিয়ায় একে সনাতন সমাজকর্ম থেকে আলাদা সত্তা দান করেছে।
৩। জাতীয় উন্নয়নঃ জাতীয় উন্নয়ন ব্যতিরেকে ভাগ্যনয়ন করা সম্ভব নয়। সমাজকর্ম এই লক্ষ্যে কাজ করে থাকে তাই সমাজের উন্নয়নের মধ্যে যোগসূত্রতা স্থাপনের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের সহায়তা করা সমাজকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৪। সর্বজনীন কল্যাণঃ সমাজকর্ম কার্যক্রম কোন বিশেষ শ্রেণী বা দলের জন্য নয়। সমাজের সকল শ্রেণী বা দল অর্থাৎ ছোট-বড় উঁচু নিচু ধনী গরিব সাদাকালো প্রভৃতি সকল মানুষের কল্যাণ সাধন করা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৫। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ মানুষের দৈহিক মানসিক সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও নৈতিক দিকসহ জীবনের সকল দিক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এগুলো একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির উন্নয়ন চিন্তা করা যায় না। সমাজকর্ম মানুষের সকল দিকের উন্নয়নে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে থাকে। এটি এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
৬। সমস্যার স্থায়ী সমাধানঃ সমাজকর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল মানুষের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা। সমস্যার কারণ প্রকৃতি ও পরিধি নির্ণয় করে যথাযথ সমাধানের পথ নির্দেশ দিয়ে থাকে সমাজকর্মী। এখানে সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রক্রিয়ায় সমাজকর্মের বিভিন্ন পদ্ধতি ও নিজস্ব সম্পদের ব্যবহার করে থাকে।
৭। পেশাগত জ্ঞান অর্জনঃ মানুষের সকল দিকের সমস্যার সমাধানের জন্য সমাজকর্মীদের পেশাগত জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। কারণ পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা সম্পন্ন সমাজকর্মীদের পক্ষেই আধুনিক সমাজকর্ম পরিচালনা করা সম্ভব তাই পেশাগত জ্ঞান অর্জন সমাজকর্মের একটি বৈশিষ্ট্য।
আরো পড়ুনঃ গ্রামীণ সমাজসেবা কি? বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজসেবা কার্যক্রম গুলোর বর্ণনা দাও।
৮। সামাজিক পার্থক্য হ্রাসঃ সমাজে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির ব্যবধান সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে। তাই সমাজের যে কোন ধরনের অসামঞ্জস্যতা দূর করা সমাজকর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৯। জনগণের চাহিদাকে অগ্রাধিকারঃ সমাজকর্ম জনগণের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকে। মানুষের সমস্যার সাথে মিলিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন করলে সমাধানও সহজ হয় তাই জনগণের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব প্রদান সমাজকর্মের আরেকটি বৈশিষ্ট্য।
১০। সম্পদের যথার্থ ব্যবহারঃ সমাজকর্ম সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে। কিভাবে সকল সম্পদের ব্যবহার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজ মানুষের সমস্যা সমাধান করা যায় তার ব্যবস্থা করে থাকে সমাজকর্ম।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজস্ত সকল মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করা সমাজকর্মের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। এজন্যই উন্নত জীবনমান অর্জনের লক্ষে সমাজকর্ম সহায়তা অত্যাবশ্যক। সমাজকর্ম একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি হিসেবে মানুষের সমস্যার সমাধান সক্ষম। একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সমাজকর্মের উক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহের উপস্থিতির অপরিহার্য।