ভাষা আন্দোলন বলতে কি বুঝ? ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর।

প্রশ্নঃ ভাষা আন্দোলন বলতে কি বুঝ? ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর। অথবা, বাংলাদেশের সমাজে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর।

earn money

ভূমিকা: ‘ভাষা আন্দোলন’ বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে সংগঠিত গণআন্দোলন।  ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে, যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। ভাষার অধিকার রক্ষার এই সংগ্রাম কেবল ভাষার প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি সামগ্রিকভাবে বাঙালি জাতিসত্তার চেতনাকে জাগ্রত করে। 

ভাষা আন্দোলন: ‘ভাষা আন্দোলন’ বাঙালির মুক্তির সংগ্রামী ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা থাকলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা বাতিল করা হয়, যা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। আন্দোলন-সংগ্রাম ও জীবনের বিনিময়ে পূর্বপাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা  করতে উদ্বুদ্ধ হয়। আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 

ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি স্থাপনকারী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গণআন্দোলন।  নিচে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য  বর্ণনা।

আরো পড়ুনঃ যুক্তরাজ্যের আইনসভার গঠন ব্যাখ্যা কর

ইউটিউবে ভিডিও লেকচার দেখুনঃ


১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ: ভাষা আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম সুসংগঠিত প্রতিরোধ। এর মাধ্যমেই বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তী স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ সুগম হয়।

২. অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে ভাষার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রভাব পড়ে।

৩. সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি: ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির মনে প্রথমবারের মতো অধিকার আদায়ের স্পষ্ট চেতনা জাগিয়ে তোলে। এ আন্দোলন থেকে প্রাপ্ত প্রেরণা থেকেই বাঙালি জাতি  পরবর্তীতে স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। 

৪. কুসংস্কার ও গোঁড়ামিতে আঘাত: তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার মধ্যেও নারীরা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে নারীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়, যা নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

৫. রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ: ভাষা আন্দোলনের ফলে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। মুসলিম লীগের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায় এবং বাঙালির স্বার্থসংশ্লিষ্ট নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে  শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত  “কৃষক শ্রমিক পার্টি (১৯৫৪)” “গণতন্ত্রী দল,” এবং জাতীয় আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) অন্যতম। 

৬. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান: ১৯৫৬ সালে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় সংঘটিত হয়।এ আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। এটি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।  

আরো পড়ুনঃ গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর

৭. যুক্তফ্রন্টের বিজয়: ভাষা আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক শক্তি  গঠনে  যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে পরাজিত  করলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কর্তৃত্বকে দুর্বার আঘাত করে।

৮. বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশ: ভাষা আন্দোলন বাংলাভাষার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিকাশে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ভাষার অধিকার ফিরে পাওয়ার ফলে বাংলা সাহিত্যিকদের মাঝে নতুন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হয়।

৯. শহীদ মিনার তৈরি ও শহীদ দিবস পালন: ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করে।

১০. সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উত্থান: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা নাটক, কবিতা, গান ও চলচ্চিত্রে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো উঠে আসে যা বাঙালি জাতির  সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১১. গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন: ভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিকে শক্তিশালী করে। এই আন্দোলনের সফলতা প্রমাণ করে যে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই তাদের দাবি আদায়ের প্রধান হাতিয়ার।

১২. স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো বাঙালিরা বুঝতে পারে যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের শোষণ ও বৈষম্য কেবল ভাষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি অর্থনীতি, প্রশাসন ও রাজনীতির প্রতিটি স্তরেই বিদ্যমান।

১৩.স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের ভিত্তি: ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য ছিল না, এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত প্রতিরোধ। ভাষা আন্দোলন বাঙালির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার দাবিকে শক্তিশালী করে।

আরো পড়ুনঃ আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণসমূহ

১৪. গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার বিকাশ: ভাষা আন্দোলনের সময় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংগ্রাম, আজাদ, ইত্তেফাক প্রভৃতি পত্রিকা আন্দোলনের তথ্য ও জনগণের মতামত তুলে ধরে, যা গণমাধ্যমের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।

১৫. শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার প্রভাব: ভাষা আন্দোলনের সফলতার ফলে বাংলা ভাষা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং প্রশাসনিক কাজেও বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত হয়।

১৬. শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব: ভাষা আন্দোলন শুধু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি শ্রমিক ও কৃষকদেরও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ফলে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে বিভিন্ন শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

১৭. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তি: ভাষা আন্দোলনই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির অধিকার হরণ করতে বদ্ধপরিকর হয় তখন ভাষা আন্দোলনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং স্বাধীনতা অর্জন করে।

পরিশেষে বলা যায়, ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম গৌরবময় অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। ৫২ সালে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষার অধিকারই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান অনুপ্রেরণা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ, বাংলাদেশ।  

Riya Akter
Riya Akter
Hey, This is Riya Akter Setu, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

ফেসবুক পেইজ

কোর্স টপিক