বাঙালি জাতির জনগোষ্ঠীর নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় বিশদভাবে আলোচনা কর

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের/বাঙালি জাতির জনগোষ্ঠীর নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় বিশদভাবে আলোচনা কর।

ভূমিকা:  বাংলাদেশে বসবাসকারী মানুষের প্রাক-ইতিহাস যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ সমর্থিত নয়। আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাবে জীবাশ্মবিজ্ঞানের গবেষণা এখানে তেমন হয়নি। আর সেকারণেই বাংলাদেশের মানুষের আদি পরিচয় ও জন্ম-উৎস এখনো অনেকটা অমীমাংসিত। 

বাঙালি জাতির উদ্ভব: এ অঞ্চলে প্রথম অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর লোকরা আসে এবং সেটি সম্ভবত পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে। এরপর একে একে দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোল, শক, সেন, বর্মণ, তুর্কি, পাঠান, ইরানি, আরবীয়, আবিসিনীয়, ইংরেজ, পর্তুগিজ, মগ, ওলন্দাজ, আলপাইন প্রভৃতি ধারার মানুষদের আগমন ঘটে। এসব নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর মিলন-মিশ্রণে বাঙ্গালীরা একটি সংকর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। অনেকের মতে সংকর জনগোষ্ঠী হওয়া সত্তেও বাঙ্গালীদের দেহবৈশিষ্ট্যে আদি অস্ট্রেলীয় বা অস্ট্রিক তথা ভেড্ডিড জনগোষ্ঠীর দৈহিক বৈশিষ্ট্য বেশি প্রকট।

আরো পড়ুনঃ সামাজিকীকরণ বলতে কি বুঝ? সামাজিকীকরণে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা আলোচনা কর। 

বাঙালি নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য: বাঙালি নরগোষ্ঠী বলতে বোঝায় এমন এক জনসমষ্টি, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। তবে বাংলাদেশ আগে কোন নরগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল কিনা, তা জানান সম্ভব নি। মানবজীবাশ্ম সম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের ঘাটতি থাকার কারণে বাংলাদেশের মানুষের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় নির্ণয় করা সহজ নয়। 

বিভিন্ন মনীষীদের দৃষ্টিকোণ থেকে: সাধারণভাবে স্বীকৃত মতামত হলো, এ অঞ্চলে আদি মানুষের বসবাস ছিল না। ফলে এখানে একসময় যারা বসতি স্থাপন করেছে তারা সবাই বহিরাগত। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষের মিলন-বিরোধের ফলে বাংলাদেশে একটা সংকর জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। স্যার হার্বার্ট রিজলে ভারতীয় উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে সাতটি উপবিভাগে বিভক্ত করেন। এগুলো হচ্ছে:

১. তুর্কীয়-ইরানীয় ( ২. ভারতীয় আর্য

৩. শক-দ্রাবিড় ( ৪. আর্য-দ্রাবিড়

৫. মঙ্গোল-দ্রাবিড় (; ৬. মঙ্গোলীয় এবং

৭. দ্রাবিড়ীয়

রিজলের মতে বাঙালিরা হল মঙ্গোল-দ্রাবিড়-প্রভাবিত একটা সংকর জনগোষ্ঠী। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, বাঙালির শ্যামলা ও পীত গায়ের রং, চওড়া (গোল) মাথা, মধ্যমাকৃতি থেকে চওড়া নাক এবং মাঝারি উচ্চতা মঙ্গোলীয় প্রভাবের সাক্ষ্য দেয়। আবার বাদামি-কালো গায়ের রং, লম্বা মাথা, চওড়া নাক, চোখের রং ও গঠন, মুখে দাড়ি-গোঁফের আধিক্য দ্রাবিড়-প্রভাবেরই ফল।

জে. হুটন ভারতীয় উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে মোট আটটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হলো:

আরো পড়ুনঃ সমকালীন বাংলাদেশে বিবাহ ও পরিবারের পরিবর্তনশীল রূপ আলোচনা কর।

১. নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটু ২. আদি-অস্ট্রেলীয় ৩. আদি-মেডিটেরিয়ান ৪. সভ্য-মেডিটেরিয়ান ৫. আর্মানীয় ; ৬. আলপাইন ৭. বৈদিক-আর্য এবং ৮. মঙ্গোলীয়

পন্ডিত বিরজাসংকর গুহ ভারত উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে ছয়টি নৃতাত্তিক ধারায় ভাগ করেছেন। এগুলো হল:

১. নিগ্রোবটু ২. আদি অস্ট্রেলীয়

৩. মঙ্গোলীয় ; ৪. মেডিটেরিয়ান

৫. আলপো-দিনারীয়) এবং ৬. নর্ডিক

নৃতত্তবিদ ভন আইকস্টেড্ট ভারতীয় উপমহাদেশের মানবগোষ্ঠীকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন। এগুলো হল:

১. ভেড্ডিড-প্রাচিন অধিবাসী; ২. মেলানীড-কৃষ্ণকায় অধিবাসী এবং

৩. ইন্ডিড-আধুনিক অধিবাসী।

ভারতীয় পন্ডিত রমাপ্রসাদ চন্দ মনে করেন যে, বাঙালিরা বৈদিক-আর্যভাষি জাতিসমূহ দ্বারা প্রভাবিত। বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে (আদিপর্ব) নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন, বাঙালির নৃগোষ্ঠী গঠনে আদি অস্ট্রেলীয় ও দ্রাবিড় প্রভাবের পাশাপাশি আর্যপ্রভাবও রয়েছে। নৃতাত্তিকরা বাংলাদেশী মানুষের দেহে নিগ্রোবটুদের প্রভাবও লক্ষ্য করেছেন। এই প্রভাবের ফলে বাংলাদেশীদের মধ্যে খর্বাকৃতি দেহ, গায়ের রং কৃষ্ণাভ, পুরু ঠোঁট, চ্যাপ্টা নাক দৃষ্টিগোচর হয়। বাংলাদেশের প্রাচীন মানুষের বিভিন্ন পর্যায়ে ভেড্ডিড রক্তের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। সাঁওতাল, মুন্ডা, পোদ, শূদ্র, বাগদী, চন্ডাল, এমনকি ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থদের মধ্যেও এ ভেড্ডিড জাতির রক্তপ্রবাহ বহমান। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর আগমন ঘটে যারা রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় অনেক বহিরাগত রাজবংশ যেমন- সেন, বর্মণ, খড়গ ও চন্দ্র বাঙালির দৈহিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া তুর্কি, পাঠান, মোঘল, ইরানি, আবিসিনীয় ও আরবীয় রক্তের ধারাও বাঙালির ধমনিতে প্রবহমান। ষোড়শ শতাব্দীতে বহিরাগত ইংরেজ, পর্তুগীজ, ডাচ, ফরাসি, দিনেমার এবং আরাকানের মগ জলদস্যুদের প্রভাবও বাঙালির রক্তে বিদ্যমান। এসবের দীর্ঘ ও পর্যায়ক্রমিক সংমিশ্রনে বাংলাদেশে সংকর বা মিশ্র জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে।

আরো পড়ুনঃ নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর।

সংকর জাতি হওয়া সত্তেও বাঙালির স্বকীয় দৈহিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। বাঙালির লম্বা প্রকৃতির মাথা, কালো চুল, চোখের মণি বাদামি বা কালো, গায়ের রং কালো-বাদামি, মাঝারি দৈহিক উচ্চতা, মুখাকৃতি লম্বা, মধ্যমাকৃতির নাসিকা এবং মুখে দাড়ি-গোঁফের প্রাচুর্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। নৃতাত্তি¡কদের মতে, এ বৈশিষ্ট্য অনেকটাই অস্ট্রিক প্রভাবিত। বাঙালির সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অস্ট্রিক ভাষার প্রকট প্রভাব রয়েছে। তবে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিতে টিবেটোবার্মা, অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং দ্রাবিড়ীয় ভাষার প্রভাবও অনস্বীকার্য।

উপসংহার: কেবল ভৌগোলিক বা নৃতাত্তিক কারণে নয়, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় উপমাহাদেশের জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক করার সুযোগ নেই। বাঙালির নরগোষ্ঠীগত পরিচয়েও তাই ভারতীয় উপমাহাদেশের বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে সার্বিক বিচারে এ মতই প্রসিদ্ধ যে, বাঙালি সংকর জাতি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর আগমনে এরূপ জাতিগত সংমিশ্রন ঘটেছে। এ সংমিশ্রন কেবল নরগোষ্ঠীগত নয়, ভাষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তবে নৃতাত্তিকদের মতে, সংকর এ জাতিগোষ্ঠীর উপর অস্ট্রিক প্রভাব দৃশ্যমান।

Share your love
Riya Akter
Riya Akter

Hey, This is Riya Akter Setu, B.A (Hons) & M.A in English from National University.

Articles: 747

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *