প্রশ্নঃ বাংলাদেশের সুশাসনের সমস্যাবলি ব্যাখ্যা করুন।
ভূমিকা: একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলত সুশাসনের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল জনবহুল দেশ। এখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ, তবে এর সম্ভাবনাও রয়েছে।
সুশাসন: According to the World Bank, “Governance is the manner in which power is exercised in the management of a country’s economic and social resources for development.”
সাধারণভাবে বলতে গেলে, ” সুশাসন এমন এক শাসন ব্যবস্থা কে বোঝায় যা একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটায়।”
আরো পড়ুনঃপল্লী উন্নয়ন বলতে কি বুঝ?
বাংলাদেশের সুশাসনের সমস্যা
জবাবদিহিতার অভাব: নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, রাজনৈতিক দল অথবা আমলাতন্ত্র, এদেশের কোন সংস্থাই স্বচ্ছ জবাবদিহিতা জনগণের নিকট প্রকাশ করে না। এগুলোর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে যেমন: ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা,অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব, প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্বল সংসদ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদিও বলা হয় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, তবুও রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয় আমলাগণ নীতি তৈরি করে আর সংসদে তা পাস হয়। এখানে জনগণ থাকে বিচ্ছিন্ন! তাই বলা যায় বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা: গণতন্ত্র যে কোন দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাধীনতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের সঠিক বিকাশ ঘটেনি। স্বাধীনতার প্রারম্ভে স্বাধীনতার স্থপতি কে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রথমে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয় এদেশে। তারপর চলে দীর্ঘ সেনাশাসন। ১৯৯১ সালে পর থেকে যদিও গণতন্ত্রের আবির্ভাব হয় তবুও নির্বাচনে হঠকারিতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। যার ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না এবং নির্বাচিত সরকার হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। যার দরুন দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক: একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিভর করে সেদেশের সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সর্বদা পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এখানে দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা না ভেবে সর্বদা ব্যক্তি অথবা একটি নির্দিষ্ট দলের কল্যাণের জন্য তারা একে অপরকে সহযোগিতার পরিবর্তে একজন আরেকজনের কাজকে বাধা দেয়।
সেনা অভ্যুত্থান: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য কর্তৃক স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশে সেনা অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। জিয়াউর রহমান, হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ, ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময়ে আমরা এদেশে এক দীর্ঘ সামরিক শাসনামল দেখেছি। সামরিক শাসনের মাধ্যমে কখনোই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেননা, সামরিক বাহিনী জনগণের প্রতিনিধি নয়। তাই তাদের কাছ থেকে সুশাসন কাম্য নয়।
আরো পড়ুনঃশ্রেণী ও জাতি বর্ণের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করো?
নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ: নির্বাহী বিভাগ হল সরকারের সেই বিভাগ যা রাষ্ট্রের সব আইন কার্যকর করে ও সরকারি নীতি প্রয়োগ করে। বাংলাদেশে সরকারি সকল বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের একক নিয়ন্ত্রণ এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
দুর্নীতি: দুর্নীতি শুধুমাত্র সুশাসন নয় সকল উন্নয়নের পথে অন্তরায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাত, ভূমি, প্রশাসন, রাজনীতি, ধর্ম ব্যবস্থা সহ সকল সেক্টরে লাগামহীন দুর্নীতি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করছে ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য নিম্ন লিখিত পন্থাসমূহ অবলম্বন করা যেতে পারে:
- দুর্নীতি দূরীকরণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
- আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
- সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
- সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।
- মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
- জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশে সুশাসনের অনেক সমস্যার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য কিছু সম্ভবনাও রয়েছে। তাই সুশাসনের সমস্যার আলোচনায় সম্ভবনাকে বাদ দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের সুশাসনের সম্ভাবনা
উন্নয়নশীল ও দুর্নীতির কালো থাবায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সুশাসনের সমস্যার পাশাপাশি অনেকগুলো সম্ভাবনাও রয়েছে নিম্নে তা আলোচনা করা হল:
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন: জবাবদিহিতা বলতে আমরা বুঝি নিজের কাজ সম্পর্কে অন্যের কাছে ব্যাখ্যা প্রদান করা। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির জন্য প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তারা তাদের কাজ গোপন রাখে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ: দুর্নীতি যেহুতু সকল উন্নতির অন্তরায় সেহেতু দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা কল্পে অবশ্যই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বজনপ্রীতি পরিহার করে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে।
এনজিওদের সেবাদানের সুযোগ তৈরি করা: বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এনজিওদের ভূমিকা রাখতে হবে। যেহেতু এদেশের সকল কর্মকাণ্ড নির্বাহী বিভাগ দ্বারা প্রভাবিত তাই এনজিওগুলোকে সরকারের বিভিন্ন বাধা-নিষেধ মেনে কাজ করতে হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এনজিওগুলোকে তাদের সঠিক ভূমিকা পালনে সহায়তা প্রদান করতে হবে।
আরো পড়ুনঃইসলামী সংস্কৃতি কী? ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভ লেখ
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ স্বরূপ। কিন্তু এদেশে যে দলীয় সরকারই নির্বাচিত হোক না কেন তারা প্রথমেই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চায়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে, একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সুশাসন বাধ্যতামূলক। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে আন্ত কলহ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমস্যার সৃষ্টি করছে। তবুও বর্তমান সরকারের সৎ মানসিকতায় দেশের অভ্যন্তরে সুশাসনের কিছুটা সম্ভাবনাময় অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাই বলা যায় বাংলাদেশের সুশাসনের সমস্যা ও সম্ভাবনা উভয় ই বিদ্যমান রয়েছে।