প্রশ্নঃ নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা আলোচনা কর।
ভূমিকা: তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের স্থান ছিল একেবারে নিচুস্তরে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ফলে নারীরা বিভিন্ন দিক থেকে সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত হতেন। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তথাকথিত সমাজের বিভিন্ন নিয়ম নীতির বিরুদ্ধে তারা সমালোচনা করেন।
নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
সামাজিকভাবে নিপীড়িত, শোষিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষার জন্য রাজা রামমোহন রায় সারাজীবন লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন সমাজ সংস্কারকমূলক কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হিত সাধন করেছিলেন। নারী শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় সেগুলি আলোকপাত করা হল –
আরো পড়ুনঃ কিশোর অপরাধ কি? কিশোর অপরাধের কারণ গুলো আলোচনা কর।
১. শিক্ষার সমান অধিকার: রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারক বিভিন্ন দিকের মধ্য দিয়ে নারী শিক্ষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সমান অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
২. নারী কল্যাণ সাধন: ঊনবিংশ শতকের ঘুণধরা পুরুতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে নারীজাতির কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়ে সমাজজীবনকে কলুষমুক্ত ও নারী শিক্ষার বিস্তার সাধন করতে চেয়েছিলেন। তাই নারী কল্যাণ সাধন ছিল রাজা রামমোহন রায়ের নারী শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
৩. সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা: তৎকালীন পুরুতান্ত্রিক সমাজে নারীর সমান সামাজিক অধিকার ছিল না। অর্থাৎ মেয়েরা সামাজিক যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতো। এমনকি মেয়েদের জন্য যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত ছিল না। রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম নারীদের সমান সামাজিক অধিকার ছাড়া সমাজের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয় একথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে উল্লেখ করেছিলেন। তাছাড়া নারীরা যাতে সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায় ও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে তার জন্য রাজা রামমোহন রায় চেষ্টা করেছিলেন।
৪. পুস্তক প্রকাশ: রাজা রামমোহন রায় ১৮২২ সালে ‘নারীদের প্রাচীন অধিকারের বর্তমান সংকোচনের উপর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য’ নামে একটি পুস্তক রচনা করেন। যেখানে নারীদের আইনসম্মত অধিকার ও তাদের শিক্ষাদান -এর জন্য দাবি করেন রাজা রামমোহন রায়। এছাড়া ‘সংবাদ কৌমুদি’ পত্রিকাতে দরিদ্র বিধবাদের সাহায্যের জন্য একটি সমিতি গঠনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন। নারী শিক্ষার উন্নতিকল্পে জন্য রাজা রামমোহন রায় যে সোচ্চার হয়েছিলেন তা কয়েকটি গ্রন্থ থেকে বিশেষভাবে জানা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (1817), গোস্বামীর সহিত বিচার (1818), সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক নিবর্তক সংবাদ (1818) প্রভৃতি। এই সমস্ত গ্রন্থে রাজা রামমোহন রায় শাস্ত্রীয় যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে নারী শিক্ষা ও নারীজাতির উন্নতির জন্য তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আরো পড়ুনঃ কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী আলোচনা কর।
৫. ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা: রাজা রামমোহন রায়ের ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের বিভিন্ন নিয়ম-কানুনগুলি নারী কল্যাণে সহায়তা করেছিল। এই ব্রাহ্মসমাজ পরবর্তীকালে নারী শিক্ষার ও নারীদের স্বাধীন চিন্তা ভাবনাকে প্রসারিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। রামমোহন রায়ের হাত ধরে পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশব সেন প্রমূখ ব্রাহ্মসমাজ ও তার কার্যাবলীকে সম্প্রসারিত করেন। তাই ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রামমোহন রায় সে যুগে নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
৬. সতীদাহ প্রথা রদ: তৎকালীন সময়ে সমাজে সবথেকে নিকৃষ্টতম প্রথা হল সতীদাহ প্রথা। অর্থাৎ স্বামী মারা গেলে মেয়েদেরকে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে হতো। নারীরা কতটা অবহেলিত, নিপীড়িত, শোষিত হলে যুগ যুগ ধরে এই প্রথা সমাজের রন্ধে প্রবেশ করেছিল। অনেক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেওরামমোহন রায় সর্বপ্রথম এই নিকৃষ্টতম প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন ও নারীদের এই অমানবিক প্রথা থেকে বের করে আনতে সচেষ্ট হন।
১৮২৯ সালের ৪ ই ডিসেম্বর গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ‘সপ্তদশ বিধি’ নামক আইন পাস করে সতিদাহ প্রথা রদ করেন। যার প্রধান কৃতিত্ব ছিল রাজা রামমোহন রায়ের। এটির মাধ্যমে রাজা রামমোহন রায় কতটা নারী শিক্ষার প্রতি সচেষ্ট ছিলেন ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
দৃঢ় ও সাহসী মনোভাব এবং কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগার সেই যুগের নারীদেরকে শিক্ষার সুব্যবস্থা করেছিলেন। পুরুষশাসিত সমাজে দীর্ঘদিন অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত নারীদের যাবতীয় অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার শিক্ষানামক মূলমন্ত্র দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর আজীবন সত্যের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এবং সাহসের সাথে দেশের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে জরাজীর্ণ সমাজে আলো জ্বালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রাচীন ধ্যানধারনাযুক্ত সামাজিক ব্যাধি নিরসনে রাজা রামমোহন রায়ের পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনকে সম্পূর্ন উৎসর্গ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর একদিকে শিক্ষাসংস্কার ও অন্যদিকে সমাজসংস্কারে নিজেকে যুক্ত করে রাখেন ও নারীসমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে বাঁচার প্রেরণা দিয়েছিলেন। আবার বিধবাবিবাহ প্রচলনের মাধ্যমে দিয়েছিলেন নারী মুক্তির স্বাদ। তাছাড়া ইংরেজদের দ্বারা প্রবর্তিত ‘চুঁইয়ে পড়ানীতি’ ছিল দেশীয় শিক্ষা ও গণশিক্ষা বিস্তারের প্রধান বাধাস্বরূপ, যেটিতে বিদ্যাসাগর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে নারী শিক্ষা বিস্তারে ব্রতী হয়েছিলেন। নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান যে-সমস্ত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল –
আরো পড়ুনঃ কল্যাণ রাষ্ট্র কি? কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যাবলী আলোচনা কর।
১. বিদ্যালয় প্রতিষ্টা: বিদ্যাসাগর মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছিলেন যে শিক্ষাসংস্কার ও সমাজসংস্কার একে অপরের পরিপূরক। সমাজের অগ্রগতি সাধন করতে গেলে শিক্ষার মধ্য দিয়ে তা করতে হবে। তাই নারীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগর ও জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেবের সহায়তায় ১৮৪৯ সালে মেয়েদের জন্য অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্টা করেন। যেটি পরে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়। ১৮৫০ সালে ডিসেম্বরে বিদ্যাসাগর বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর এই বেথুন স্কুলে দীর্ঘদিন সম্পাদক হিসেবে স্কুল পরিচালনায় যথেষ্ট যোগ্যতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।
২. বিদ্যালয় পরিচালনা: বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের বলিষ্ট মতাদর্শ পাওয়া য়ায়। বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যেসমস্ত সুপারিশ করেছিলেন, তা হল –
- একজন শিক্ষকের পরিবর্তে দু’জন শিক্ষক নিয়োগ,
- উপযুক্ত যোগ্যশিক্ষক (পন্ডিত) নিয়োগ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন নির্ধারন,
- উচ্চবেতন দিয়ে (কমপক্ষে মাসিক ৫০ টাকা) একজন হেড পন্ডিত নিয়োগ,
- বিদ্যালয়গুলিতে উপযুক্ত পরিদর্শক নিয়োগ প্রভৃতি।
৩. নারীশিক্ষা ভান্ডার গঠন: বিদ্যাসাগর কেবলমাত্র বিদ্যালয় গঠন করে থেমে থাকেনি।সরকারিভাবে আর্থিক সাহায্য পর্যাপ্ত না আসার ফলে, তিনি বিদ্যালয়গুলি সঠিকভাবে পরিচালনা ও পর্যাপ্ত পরিমানে অর্থযোগানের জন্য বেসরকারীভাবে ‘নারীশিক্ষা ভান্ডার’ নামক তহবিল গঠন করেন। এখানে রাজা প্রতাপচন্দ্র ও আর ও অনেক শিক্ষানুরাগী ব্যাক্তিবর্গ নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। তাছাড়া তৎকালীন ছোটলাট বিডন সাহেবও মাসিক ৫৫ টাকা করে অর্থ সাহায্য করতেন।
৪. শিক্ষার পাঠ্যক্রম: বিদ্যালয় শিক্ষার অগ্রগতির জন্য বিদ্যাসাগর এক রিপোর্টে (১৮৬২ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর) জানান -পড়ালেখা, অঙ্ক, জীবনচরিত, বাংলা, ইতিহাস নানা বিষয়ে মৌলিক পাঠ এবং সেলাই প্রভৃতি মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে।
৫. ভাষা মাধ্যম: ভাষা মাধ্যম সম্পর্কে বিদ্যাসাগর বলেন – শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা (বাংলা), ইংরাজীতে নয়। তিনি আরোও বলেন – “বাংলা শিক্ষার বিস্তার ও সুব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজনীয়, তা না হলে দেশের জন সাধারণের কল্যাণ হবে না।”
আরো পড়ুনঃ মাদকাসক্তি কি? এ সমস্যার সমাধানে একজন সমাজকর্মীর ভূমিকা আলোচনা কর।
৬. পাঠ্যপুস্তক রচনা: বিদ্যাসাগর উপলব্ধি উপযুক্ত শিক্ষার জন্য চাই ভালো ভালো পাঠ্যপুস্তক যা শিক্ষার্থীদেরকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করবে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকের অভাব পুরনে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, যেমন – বর্ণপরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ – ১৮৫৫), বোধদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬) প্রভৃতি। বিদ্যাসাগরের আগে পর্যন্ত নারীশিক্ষা বিস্তারে নারীশিক্ষার বিভিন্ন স্কুল থাকলেও বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলি সেই সময়ে সারা ভারতবর্ষে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল।
উপসংহার: সর্বোপরি বলা যায় নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন আধুনিক ভারতের অন্যতম পথিকৃৎ। রাজা রামমোহন রায় চিন্তা ভাবনা সমাজের কুসংস্কার এর উপর বারবার আঘাত এনেছে। তাই তিনি যেভাবে শিক্ষা সংস্কার, সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার প্রভৃতি দিকে বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আবার, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিদ্যাসাগর নিজেই ছিলেন রেনেসাঁস অর্থাৎ শিক্ষার মধ্য দিয়ে নারী জাগরণের নারী শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম কান্ডারী। বিদ্যাসাগর নিজের সুখটুকু বিসর্জন দিয়ে, পরিবার ও গ্রামের সঙ্গে বিচ্ছেদ সাধন করে তিনি তাঁর লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাই নারী কল্যাণ ও সংস্কারক হিসেবে এই দুই মহা মানবের অবদান অনস্বীকার্য।